হার্নিয়া রোগ সম্পর্কিত
হার্নিয়া কি ও উপসর্গ, ইনগুইনাল হার্নিয়া, আমবিলিকাল হার্নিয়া, ইনসিশনাল হার্নিয়া, রিকারেন্ট হার্নিয়া
হার্নিয়া
আমাদের পেট একটি থলি বা ব্যাগের মত। মাংসপেশী ও চামড়া দিয়ে এই ব্যাগটা তৈরি আর এই ব্যাগের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ যেমন নাড়িভূড়ি, মূত্রথলি ইত্যাদি । এই মাংসপেশীর কোন একটি জায়গা দূর্বল বা ছিদ্র হয়ে গেলে উক্ত ছিদ্র দিয়ে পেটের ভেতরের অঙ্গ বাহিরে চলে আসে, মাংসপেশী ও চামড়ার মধ্যবর্তী স্থানে। সাধারনত জোড়ে কাশি দিলে অঙ্গগুলো চামড়ার নীচে চলে আসে এবং জায়গাটা ফুলে যায়। ফোলা জায়গাটা হাত দিয়ে চাপ দিলে অঙ্গগুলো আবার পেটের ভিতর চলে যায় এবং ফোলা জায়গাটা সমান হয়ে যায়। একেই হার্নিয়া বলে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, দাড়ালে বা জোড়ে কাশি দিলে পেটের দেয়ালের কোন অংশ যদি ফুলে ওঠে এবং শুয়ে পড়লে বা হাত দিয়ে চাপ দিলে যদি ফোলাটা কমে যায় তাহলে এটা হার্নিয়া।
কিছু হার্নিয়া জন্মগতভাবেই থাকে, আর কিছু হার্নিয়া সময়ের সাথে দেখা দেয়।
শুধু পেটেই হার্নিয়া হয় তা নয়, শরীরের অন্য জায়গাতেও হার্নিয়া হতে পারে। তবে পেটেই বেশি হয়।
সাধারনত কুচকিতেই হার্নিয়া বেশি হয়ে থাকে। কুচকির মাংসপেশী ভেদ করে নাড়িভূড়ি অন্ডথলিতে চলে আসে এবং অন্ডথলি ফুলে বড় হয়ে যায়।
হার্নিয়া ঔষধে ভালো হয় না, অপারেশনই এর একমাত্র সমাধান।
হার্নিয়ার উপসর্গ সমূহ:
- ফুলে যাওয়া
- ব্যথা – ব্যথা সাধারনত সহ্যের মধ্যেই থাকে তবে ভারী কাজ বা ব্যয়াম করলে ব্যথা বেড়ে যায়।
- জ্বালা-যন্ত্রনা করা
- ভারী ভারী লাগা
- পেটের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়া
এই উপসর্গগুলোই রোগীরা নিজের ভাষায় বলেন, যেমন-
- আমার কুচকিতে চামড়ার নীচে ফোলা আছে
- পরিশ্রম করার পর আমার কুচকি টাইট হয়ে আসে
- ব্যাথার কারনে হাঁটা বন্ধ করে দিতে হয়
- আমি জগিং করতে পারি, কিন্তু বলে কিক করতে অনেক কষ্ট হয়
- যখন দৌড়াই, তখন কুচকিতে অন্যরকম অনুভূতি হয়।
- যখন জোড়ে দৌড়াই, তখন অনেক কষ্ট হয়।
- ভারী জিনিস ওঠানোর পর, হার্নিয়াটা অনেকক্ষন ব্যথা করে।
ইনগুইনাল বা কুচকির হার্নিয়া (Inguinal Hernia)
সবচেয়ে কমন হার্নিয়া
২০ জন পুরুষের মধ্যে ১ জনের ইনগুইনাল হার্নিয়া আছে।
সকল হার্নিয়ার ৮০ ভাগই ইনগুইনাল হার্নিয়া।
মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশী হয়, শতকরা ২৫ ভাগ।
কুচকির মাংসপেশী দূর্বল বা ছিদ্র হয়ে গেলে, মাংশপেশী ভেদ করে নাড়িভূড়ি চামড়ার নীচে চলে আসে এবং কুচকি ফুলে যায়, এটাকেই ইনগুইনাল হার্নিয়া বলে। এই হার্নিয়া বড় হয়ে গেলে, নাড়িভূড়ি অন্ডথলিতে চলে আসে এবং অন্ডথলি ফুলে বড় হয়ে যায়। শুয়ে পড়লে বা হাত দিয়ে চাপ দিলে ফুলাটা থাকে না, কারন সব নাড়িভূড়ি আবার পেটের ভিতর চলে যায়। ইনগুইনাল হার্নিয়া এক বা দুই কুচকিতেই হতে পারে।
উপসর্গ: কুচকি ফুলে যাওয়া, ব্যথা, ব্যয়াম বা ভারী কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি
কারনসমূহ: যেসব কারনে ইনগুইনাল হার্নিয়া হয়:
- বংশগত (ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভ যেমন- বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এর হার্নিয়া রোগ থাকলে, হার্নিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে)।
- পুরুষদের ৮ গুন বেশী হার্নিয়া হয়, মহিলাদের তুলনায়।
- হার্নিয়া সবচেয়ে বেশী হয় ৫ বছর বয়সে এবং ৭০-৮০ বছর বয়সে।
- কোলাজেন মেটাবলিজমে তারতম্য হলে।
- প্রস্টেট অপারেশন হয়ে থাকলে।
- ওজন কম হলে।
- এক পাশে হার্নিয়া থাকলে।
- কালো জাতি/বর্ণ এর লোকদের হার্নিয়া কম হয়।
- দীর্ঘদিনের কোষ্টকাঠিন্য।
- ভারী ওজন ওঠানো।
- ফুসফুসের সমস্যা – দীর্ঘদীনের কাশি, সিওপিডি রোগ।
- Ref: International guidelines for groin hernia management – The HerniaSurge Group. https://doi.org/10.1007/s10029-017-1668-x
আমবিলিকাল বা নাভির হার্নিয়া (Umbilical Hernia)
নাভি সাধারনভাবেই পেটের একটি দূর্বল জায়গা। নাভি বা এর আশেপাশের মাংশপেশী আরো বেশী দূর্বল হয়ে পড়লে এই হার্নিয়া হয়। গর্ভধারনের পরে মহিলাদের এই হার্নিয়া হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য কারনেও এটি হতে পারে, যেমন-
- কোলাজেন মেটাবলিজমে তারতম্য।
- অতিরিক্ত ওজন।
- বেশী বয়স।
- পুরুষদের বেশী হয়, মহিলাদের তুলনায়।
- ধুমপান।
- দীর্ঘদিনের কোষ্টকাঠিন্য।
- ভারী ওজন ওঠানো।
- ফুসফুসের সমস্যা – দীর্ঘদীনের কাশি, সিওপিডি রোগ।
ইনিসিশনাল বা অন্য অপারেশন পরবর্তী হার্নিয়া (Incisional Hernia)
অন্য কোন অপারেশনের ক্ষতস্থান দূর্বল হয়ে এই হার্নিয়া তৈরি করে। পেটে নানা ধরনের অপারেশন হতে পারে। পেটের চামড়া ও মাংশপেশী কেটে পেটের ভিতর ঢোকা হয় এবং অপারেশন শেষে মাংসপেশী আবার সেলাই করে দেয়া হয়। যদিও সার্জনরা আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরন করেই সেলাই করেন, তারপরও সেলাইকৃত মাংসপেশী পূর্বের ন্যায় ১০০ ভাগ শক্তিশালী হয় না বরং কমপক্ষে ২০ ভাগ দূর্বল হয়ে পড়ে এবং কিছু কিছু কারনে আরও বেশীও হতে পারে। যেমন – রোগীর কোলাজেন মেটাবলিজমে তারতম্য, অতিরিক্ত শারীরিক ওজন, বেশী বয়স, ধুমপান, ডায়াবেটিস, যক্ষা বা টিবি, ইমুইনসাপ্রেশন, কোষ্টকাঠিন্য, ভারী ওজন ওঠানো, অতিরিক্ত কাশি ইত্যাদি। কোন রোগীর এসব কারনগুলো উপস্থিত থাকলে তার মাংসপেশী আরও অনেক বেশী দূর্বল হবে এবং আস্তে আস্তে হার্নিয়ায় পরিনত হবে।
‘টেনশন ফ্রি মেস রিপেয়ার’ অপারেশেই এর একমাত্র চিকিৎসা। এসবক্ষেত্রে রোগীর দূর্বল মাংসপেশী রিপেয়ার করা হয় এবং ওখানে আধুনিক একটি মেস বা জালি বসিয়ে দেয়া হয়। এই মেস দিন যত যাবে, মাংসপেশী ও তার আশেপাশের জায়গাকে ততই শক্তিশালী করতে থাকবে, যাতে পুনরায় মাংসপেশীগুলো দূর্বল হয়ে আবারও হার্নিয়ার সৃষ্টি না করে। এটাই বর্তমানের সর্বাধুনিক চিকিৎসা।
পেডিয়েট্রিক বা বাচ্চাদের হার্নিয়া (Pediatric Hernia)
বড়দের যেসব হার্নিয়া হয়, শিশুদেরও সেসব হার্নিয়া হতে পারে। তবে ইনগুইনাল বা কুচকির হার্নিয়া এবং আমবিলিকাল বা নাভির হার্নিয়াই সবচেয়ে বেশী হয়। কুচকি বা ইনগুইনাল হার্নিয়ার একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন। নাভির হার্নিয়ার ক্ষেত্রে, শিশুর বয়স ৪ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়। বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে নাভির মাংশপেশী শক্তিশালী হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই হার্নিয়া আর থাকে না, অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। তবে ৪ বছর বয়সের পরও যদি হার্নিয়া থাকে সেক্ষেত্রে অপারেশনই চিকিৎসা।
উপসর্গ: কুচকি এবং অন্ডকোষ ফুলে যাওয়া, অতিরিক্ত কান্না বা ব্যথা।
বাচ্চাদের হার্নিয়া কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। হার্নিয়া কোন কারনে আটকে গেলে, বাচ্চারা খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং চিকিৎসার জন্য খুব অল্প সময় পাওয়া যায়। বাচ্চাদের ইনগুইনাল হার্নিয়ার চিকিৎসাও অপারেশন, তাই সুবিধামত সময়ে সার্জনের পরামর্শমত দ্রুত অপারেশন করে নেয়া উচিত, না হলে বাচ্চার শারীরিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে। হার্নিয়ার সাথে সাথে বাচ্চার অন্ডকোষ সঠিক স্থানে আছে কিনা সেটা দেখাও জরুরী এবং আপনার সার্জন এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন।