অপারেশনের প্রস্তুতি
প্রথম কাজটি হচ্ছে সার্জনের এপয়েন্টমেন্ট নেয়া। সার্জন ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনাকে দেখে রোগ নির্ণয় করবেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিবেন, প্রি এনেসথেটিক চেকআপ করা হবে, আপনার জন্য সর্ব্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হবে এবং অপারেশনের তারিখ দেয়া হবে।
ব্যক্তিগত চেম্বারে সার্জনকে দেখানো – রোগীর সাথে একজন অভিভাবক চেম্বারে প্রবেশ করতে পারবেন। সার্জনের সাথে আপনার উপসর্গগুলো নিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারবেন। রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আলাদা একটি স্থানে রোগীকে পরীক্ষা বা এক্সামিনেশন করা হবে। একজন মহিলা কর্মী বা নার্সের উপস্থিতিতে মহিলা রোগীদের পরীক্ষা করা হয় এবং উক্ত সময়ে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। পরীক্ষা বা এক্সামিনেশন করার পর সার্জন আপনার রোগ নিয়ে কথা বলবেন ও প্রাথমিকভাবে একটি চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিবেন।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো – হার্নিয়া রোগ ও এর ব্যপ্তি আরো সঠিকভাবে নির্ণয় করার জন্য কিছু ইমেজিং পরীক্ষা দেয়া হবে যেমন আল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যান। অপারেশন এবং এনেসথেসিয়ার ধকল সহ্য করার জন্য রোগীর শরীর ফিট বা প্রস্তুত আছে কিনা তা দেখার জন্য বেশ কিছু ল্যাবরেটরি ও ইমেজিং পরীক্ষা দেয়া হবে যেমন রক্ত, ইউরিন, বুকের এক্সরে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি ইত্যাদি। এগুলো ঐদিন বা আপনার সময়মত করে ফেলবেন। পরীক্ষার রিপোর্টগুলো নিয়ে আবার সার্জনের সাথে দেখা করবেন।
প্রি এনেসথেটিক চেক আপ – পরীক্ষার রিপোর্টসহ সেন্টারে আসলে প্রথমেই একজন এনেসথেসিওলোজিস্ট ডাক্তার আপনাকে দেখে এই চেকআপটি সম্পন্ন করবেন এবং সিদ্ধান্ত দিবেন অপারেশনটি আপনার জন্য কতটা নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ন। এরপর আপনাকে সার্জনের চেম্বারে পাঠানো হবে।
সর্ব্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা – প্রত্যেক রোগীর শারীরিক গঠন ও রোগ আলাদা আলাদা। তাই সার্জন আপনার সকল রেকর্ড পর্যালোচনা করে যেটা আপনার জন্য বেস্ট হবে সেই অপারেশনের সিদ্ধান্তটি দিবেন এবং আপনার অভিভাবকদের সাথে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করবেন। অন্য আর কি কি অপশন বা উপায় আছে সেটাও জানানো হবে। আপনি, আপনার অভিভাবক ও সার্জনের যৌথ সম্মতিতে অপারেশন প্ল্যান চুড়ান্ত হবে এবং উভয়পক্ষ সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করবেন।
অপারেশনের প্যাকজ ও তারিখ নির্ধারন করা – ঢাকার দুটি হাসপাতালে আমাদের সার্জনরা অপারেশন করে থাকেন। হাসপাতাল ও কেবিনের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের প্যাকজে রয়েছে। আপনার সুবিধা অনুযায়ী জন্য যে কোন একটি প্যাকেজ বেছে নিতে পারবেন। এই ব্যাপারে আমাদের সেন্টারের ম্যানেজার আপনাকে সাহায্য করবেন।
নির্দিষ্ট কিছু বার এবং সময়ে আমাদের সার্জনরা অপারেশন করে থাকেন। অপারেশনের সিডিউল ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে আপনাকে সবচেয়ে কাছাকাছি একটি তারিখ দেয়া হবে। হাসপাতালের ঠিকানা, অপারেশনের তারিখ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তারিখ ও সময় সবকিছু আপনাকে লিখে দেয়া হবে। সব কাগজ সহ, সময় অনুযায়ী উক্ত হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হবেন। যেকোন প্রয়োজনে আমাদের হটলাইনে যোগাযোগ করবেন।
অপারেশনর দিনের প্রস্তুতি:
যেদিন অপারেশন হবে সাধারনত ঐদিন হাসপাতালে ভর্তি হবেন। সময়টা আগেই জানিয়ে দেয়া হবে। অপারেশনের পর সাধারনত ১ দিন বা ২ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। অপারেশনের ৮ ঘন্টা আগে হতে কিছু খাওয়া যাবে না, এমনকি পানিও না (বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সময়টা ভিন্ন ভিন্ন হবে)। হাসপাতালে আসার আগে সাবান দিয়ে গোসল করবেন। হাসপাতালে আসার সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ, এক্সরে, সিটিস্ক্যান ফিল্ম, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সহ সকল ডকুমেন্টস নিয়ে আসবেন। শরীরে কোন অলংকার পরা থাকলে সেটা খুলে ফেলতে হবে যেমন আংটি, তাবিজ, কানের দুল, চুড়ি, ব্রেসলেট, নাকফুল ইত্যাদি। মহিলাদের চুলগুলো বেনী করতে হবে। নার্স আপনাকে এসব ব্যপারে সাহায্য করবেন। যেস্থানে অপারেশন করা হবে সেই স্থানে এবং তার আশে পাশের স্থানের চামড়ার লোম শেভ করা হবে। আপনার যেই পাশে হার্নিয়া বা যেই স্থানে হার্নিয়া সেখানে মার্কার কলম দিয়ে দাগ দেয়া হবে। আপনি সচেতনভাবে লক্ষ্য করবেন সঠিক জায়গায় বা সঠিক পাশে দাগ দেয়া হচ্ছে কিনা। ব্যপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
আপনি ব্লাড প্রেসারের ঔষধ নিয়মিত খেয়ে থাকলে অপারেশনের আগ পর্যন্ত সময় অনুযায়ী অল্প পানি দিয়ে খাবেন। এসপিরিন (ইকোস্প্রিন) বা ক্লোপিডগরেল জাতীয় ঔষধ অপারেশনের ৫ দিন আগে থেকে বন্ধ রাখতে হবে। সকল প্রকার ঔষধের ব্যপারে আগে থেকেই আপনাকে পরিষ্কার ধারনা দিয়ে দেয়া হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালের কর্মীরা আপনাকে অপারেশন থিয়েটারের নিয়ে যাবে। ওখানে সার্জনের সাথে আপনার দেখা হবে। সার্জনের সাথে কথা বলার পর পরই আপনাকে অবেদন করা হবে এবং অপারেশন শুরু হবে।
অপারেশন পরবর্তী পরামর্শ:
অপারেশন শেষ হবার পর পরই রোগীর জ্ঞান ফিরানো হবে এবং রোগীর অভিভাবককে দেখিয়ে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নেয়া হবে। রোগীর বর্তমান অবস্থা ও অপারেশন কেমন হল, ইত্যাদি ব্যাপারে রোগীর একজন অভিভাবককে বিস্তারিত জানানো হবে। পোস্ট অপারেটিভ রুমে রোগীকে প্রয়োজন অনুসারে ব্যথানাশক ও ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়, যেন রোগী কোন ধরনের কষ্ট না পায়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হয়, সময়টা একেক রোগীর জন্য একেক রকম হতে পারে। পোস্ট অপারেটেভ রুমের ডাক্তার যখন নিরাপদ মনে করবেন তখন রোগীকে কেবিনে পাঠাবেন। পোস্ট অপারেটিভ রুমে আপনি সার্বক্ষনিক ডাক্তার, নার্স ও সহায়তাকারীদের সাহায্য পাবেন।
ঘুম ভাঙ্গার পর পর ই আপনি আপনার সুবিধামত নড়াচড়া করতে পারবেন। উঠে বসবেন, লম্বা লম্বা শ্বাস নিবেন, হাটবেন। দাঁত ব্রাশ করবেন, ঠোঁটে ভেসলিন লাগাবেন। কিছুটা ব্যাথা থাকবে কয়েকদিন। ব্যথার জন্য ঔষধ খেতে দেয়া হবে এবং ব্যথা বেশী হলে সাপোজিটরী দেয়া হবে।
সাধারনত অপারেশনের পর ৬ ঘন্টা পর্যন্ত কিছু খাওয়া যায় না। মুখ শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে গড়গড়া করতে পারেন। ৬ ঘন্টা পর লিকুইড জাতীয় খাবার খাওয়া যায় যেমন পানি, ডাবের পানি, শরবত, ফলের জুস, ক্লিয়ার স্যুপ ইত্যাদি। এসব খাবারে কোন সমস্যা না হলে আপনি অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার আস্তে আস্তে খেতে পারবেন।
সাধারনত ইনগুইনাল হার্নিয়া অপারেশনের ১ দিন পর এবং আমবিলিকাল বা ইনসিশনাল হার্নিয়া অপারেশনের ২ দিন পর ছুটি দেয়া হয়।
অপারেশনের ৭ দিন পর সার্জনের চেম্বারে দেখা করতে হবে ড্রেসিং ও সেলাই কাটার জন্য।
সাধারনত ১ বা ২ সপ্তাহ পর কাজে যোগদান করা যায় এবং সকল প্রকার স্বাভাবিক কাজ করা যায়। তবে কখনো কখনো ৩ সপ্তাহ লাগতে পারে, কারন সবার শারীরিক সক্ষমতা এক নয়।
বাসায় থাকাকালীন অবস্থায় পরামর্শ:
স্বাভাবিক হাঁটা-চলা করবেন। স্বাভাবিক সকল খাবার খেতে পারবেন।
ডায়াবেটিস, প্রেসার ইত্যাদি বিভিন্ন রোগের জন্য নিয়মিত ঔষধ সেবন করে থাকলে, সেগুলো আগের নিয়ম মত চলবে। কিন্তু এসপিরিন (ইকোস্প্রিন) বা ক্লোপিডগরেল জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না।
দিনে ৩ লিটার পানি পান করবেন।
শাকসবজি ও ফলমূল বেশী করে খাবেন। যেমন- পাঁকা পেঁপে, বেল, আপেল, কলা, গাজর ইত্যাদি
ভারী ওজন ওঠাবেন না। ৫ কেজির বেশী ওজন ওঠাবেন না, কমপক্ষে ২ মাস।
শরীরের ওজন বাড়াবেন না, অপারেশন পরবর্তী কমপক্ষে ৬ মাস।
ভারী ব্যয়াম করেবেন না, অপারেশন পরবর্তী কমপক্ষে ২ মাস।
গোসল করতে পারবেন – বিশেষ ধরনের ব্যান্ডেজ দেয়া হয় যেটা পানিতে ভেজালেও সমস্যা হয় না।
ইনগুইনাল হার্নিয়ার ক্ষেত্রে – টাইট আন্ডারওয়ার পরে থাকবেন (পুরুষ রোগী)
আমবিলিকাল বা ইনসিশনাল হার্নিয়ার অপারেশনের ক্ষেত্রে -শেখানো পদ্ধতিতে পেটের বেল্ট ব্যবহার করবেন। ড্রেন টিউবের ব্যাগের রস প্রতিদিন সকালে ফেলে দিবেন এবং ফেলা দেয়া রসের পরিমান লিখে রাখবেন। পদ্ধতিটি আপনাকে শিখিয়ে দেয়া হবে।
অপারেশন পরবর্তী এক সপ্তাহ গাড়ি ড্রাইভ করবেন না।
সামান্য ব্যথা, সামান্য জ্বর, এক বা দুই বার বমি ইত্যাদি উপসর্গ স্বাভাবিক, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
মনে রাখবেন, আপনার একটি অপারেশন হয়েছে। অপারেশনের ধকল কাটাতে সাধারনত ১ সপ্তাহের মত সময় লাগে। তাছাড়া সবার সহ্য ক্ষমতা একরকম নয়।
অপারেশনের পর কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত জায়গাটা হালকা ব্যথা, জ্বালা যন্ত্রনা ইত্যাদি থাকতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এগুলো ভালো হয়ে যাবে।
সেসব উপসর্গ দেখলে দ্রুত সেন্টারে যোগাযোগ করবেন – কাঁপুনি দিয়ে তীব্র জ্বর, বার বার বমি, পেটে অসহ্য ব্যথা, তীব্র মাথা ব্যথা, ব্যান্ডেজ ভিজে রস গড়িয়ে পড়া ইত্যাদি।